শরীফ ইকবাল রাসেল,নরসিংদী:
৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে নরসিংদীর ঘোড়াশালে আটিয়াগাও গ্রামে একই বাড়িতে শিশুসহ ১৮ নর-নারীকে হত্যা করা হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় গ্রামের সকল ঘর-বাড়ি। নির্মম হত্যাযজ্ঞে গ্রামের শিশুসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০জন নারী পুরষকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। এরপর এই দিনটি আসলেই এলাকার মানুষ আজও আৎকে উঠে। সরকারের তরফ থেকে নেই কোনো উদ্যোগ।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয়ের ৯ দিন পূর্বে দেশজুড়ে যখন কোণঠাসা পশ্চিমা হানাদার বাহিনী। ঠিক সেই মুহুর্তে ঘোড়াশালে কয়েকটি খন্টযুদ্ধ হয় মুক্তিকামী বাঙালীর সাথে। বিজয়ের কাছাকাছি সময়ে পাকিস্তানীরা ফিরে যাওয়ার সময় ৬ ডিসেম্বর ঘোড়াশালের আটিয়াগাঁও গ্রামে প্রবেশ। গ্রামে প্রবেশ করেই আবুল কাসেমের বাড়িতে হত্যাকা- চালায়। এসময় বাড়িতে থাকা ৪ মাসের শিশু আয়শাসহ হত্যা করা হয় মোকছেদ আলী, মালাবক্স, শাহাজাহান, রহম আলী, আঃ হেকিম, হযরত আলী, আম্বিয়া খাতুন, মজিদা, শাহাজউদ্দিন, নেহাজউদ্দিন ও নেজু সহ প্রায় ১৮ নর-নারীকে। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর। এভাবে শুধুুমাত্র আটিয়াগাও গ্রামেই ২৫ থেকে ৩০ নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহত হয় আরো প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন। হত্যা যজ্ঞের পরদিনে তাদের অনেককেই গণকবর হিসেবে মাটি দেয়া হয়। সেই গণকবরগুলো আজ অরক্ষিত। ঝোপঝাড়ে পরিনত। সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোন উদ্যোগ। আর শহীদ পরিবারের খাতায়ও তাদের নাম আছে কিনা কেউ জানেনা। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সহায়তায় শহীদ প্রতি পরিবারের জন্য দেয়া দুই হাজার করে টাকা দেয়া ছাড়া তাদের ভাগ্যে জোটেনি কিছুই। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে একবার খোজও নেননি বলে পরিবারগুলোর অভিযোগ।
আটিয়াগাঁও এরাকার শহীদ হযরত আলীর ছেলে মো: হাবিবুল্লাহ বলেন, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীরা আমার বাবা, দাদী ও ফফুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। পাক বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে মা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে আমাদের নি:শ্ব করে দেয়া হয়েছিল। আমাদের চলার মতো তেমন কিছুই ছিলনা। আশপাশের গ্রামের লোকজন আমাদের চলার পথে সহায়তা করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার আজ ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সাংবাদিক ছাড়া কেউ আমাদের খবর নেয়নি। এছাড়া শহীদ পরিবারের তালিকায় নাম আছে কিনা তাও জানেনা তারা।
একই এলাকার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্তার বাবুল জানান, পাক বাহিনীরা এই এলাকায় প্রবেশ করে প্রথমেই আমাদের ঘরে আগুন দেয়। এসময় বাড়িতে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। পাক বাহিনীর সদস্যরা ৪মাসের শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তবে কয়েকজন বাড়ির পাশে গর্তকরে তাতে লুকিয়ে থেকে কোনক্রমে অজ্ঞান অবস্থায় পরে থেকে রক্ষা পায়।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রাহাতুন বেগম জানান, তখন অগ্রহায়ন মাস বাড়ির পাশেই ধানের কাজ করতে ছিলেন। এমন সময় পাক বাহিনীর সদস্যরা এসে বাড়িঘরে আগুন দেয়। আর গুলি করে হত্যা করে যাকে সামনে পায়। পরে নিহতদের গণকবর হিসেবে দেয়া হয়। এখানে এখন ঝোপঝাড়ে পরিনত।
এলাকার শহীদদের গণকবর স্থানে বদ্যভূমি নির্মানের পাশাপাশি পরিবারগুলোর সহায়তায় সরকারকে পাশে দাড়ানোর দাবী জানান স্থানীয় ঘোড়াশাল পৌরসভা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর সাবেক কমান্ডার ও সাবেক স্থানীয় কাউন্সিলর বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক ভূইয়া।
এঅঞ্চলের ট্র্যাজেডির কথা উল্লেখ করে শহীদ পরিবারের গুলোর স্মৃতি রক্ষার্থে একটি বদ্যভূমি নির্মানের জন্য সরকারের প্রতি দাবী জানান পলাশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ জাবেদ হোসেন।
বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে আজ এলাকাবাসীর দাবী হত্যাযজ্ঞে নিহত শহীদদের তালিকা প্রনয়ন, গণকবর তৈরী করে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথমর্যাদা দানের। এতে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা স্থানীয়দের।
#
শরীফ ইকবাল রাসেল
নরসিংদী