সুমন পালঃ দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে একটি সুপ্রাচীন ও বিখ্যাত জনপদের নাম নরসিংদী।
মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর বিধৌত প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের লালিত এ জেলা। রাজা নরসিংহ পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে একটি ছোট নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নরসিংহ নামের সাথে পরবর্তীতে দী যুক্ত হয়ে নরসিংদী নামের উৎপত্তি হয়। জমিদারি আমলে নরসিংদী অঞ্চলটি মহেশ্বরদী পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর নরসিংদী ছিল ঢাকা জেলাধীন নারায়নগঞ্জ মহকুমার একটি থানা। পরে ১৯৭৭ সালে নরসিংদীকে উক্ত জেলাধীন একটি মহকুমায় উন্নীত করা হয় এবং ৩,৩৬০.৫৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে ১৯৮৪ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। জেলার উত্তরে কিশোরগঞ্জ, পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দক্ষিণে নারায়নগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পশ্চিমে গাজীপুর পরিবেষ্টিত।
এ জেলার রয়েছে এক গৌরবময় প্রাচীন ইতিহাস। জেলার বেলাব উপজেলার উয়ারী-বটেশ্বর এলাকায় অসমরাজার গড় নামক স্থানে প্রায় তিন হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ জেলার রয়েছে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ঢাকার বাইরে প্রথম হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে এ জেলার পাঁচদোনা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবলভাবে প্রতিরোধ করে এবং যুদ্ধ শুরু করে। এ যুদ্ধে পাক বাহিনীর একটি সাজোয়া যান ধ্বংস হয়, হতাহত হয় বেশ কিছু পাকিস্তানী সৈন্যও।
এছাড়া দীর্ঘ ৯ মাস নরসিংদী জেলার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক খন্ড যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ১১৬ জন বীর সন্তান। এ সব বহু হত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞের পর অবশেষে পাকবাহিনীর পরাজয় এবং আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে ১২ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় এ নরসিংদী।
তাছাড়াও ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের নায়ক শহীদ আসাদ, মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রাপ্ত ফ্লাইট লে: মতিউর রহমান, বরণ্যে কবি সামসুর রাহমান, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ড.আলাউদ্দিন আল আজাদ ও পবিত্র কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন এ জেলারই সন্তান।
রাজধানীর সন্নিকট এ জেলাটি কৃষিনির্ভর ও দেশীয় তাঁত কাপড়ের জন্যে বিখ্যাত বাংলার ম্যানচেষ্টার খ্যাত শেখেরচর-বাবুরহাট এ জেলায় অবস্থিত।
এছাড়া ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এ জেলা সাগর কলার জন্য বিখ্যাত এবং সবজির জন্যে খ্যাতি দেশজুড়ে।
এখানকার উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ হয়ে থাকে।
৬টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ জেলায় রয়েছে ৫টি সংসদীয় আসন। লোক সংখ্যার বসবাস রয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ।
দর্শনার্থীদের চমকে দেয়ার মত এ নরসিংদী জেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান।
তার মধ্যে আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনায় ‘ড্রিম হলিডে পার্ক, মাধবদী হেরিটেজ রিসোর্ট, রায়পুরা উপজেলার মরজাল ওয়ার্ন্ডার পার্ক, পান্থশালা, রিভারভিউ, শিবপুর উপজেলায় আন্দন পার্ক, চিনারদী বিল, সোনামুখী টেক, মনোহরদী উপজেলায় বৈশাখী পার্ক বেলী ও বেলাব উপজেলায় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের প্রাচীন বাংলার অনন্য প্রত্ননিদর্শন দেশের প্রথম উন্মুক্ত প্রত্ন জাদুঘর উয়ারী-বটেশ্বর।
এছাড়াও রয়েছে, উন্মুক্ত পরিবেশে নরসিংদীর নাগরিয়াকান্দি মেঘনাপাড় শেখ হাসিনা সেতু নিকট বিনোদন পার্ক, বাদুয়ারচর ব্রিজ এবং পলাশ উপজেলার চরসিন্দুর সেতু, মাধবদী বালাপুর জমিদার বাড়ী, পলাশের ডাঙায় লক্ষন সাহার জমিদার বাড়ী, আহমেদ কবির মনু মিয়ার জমিদার বাড়ী, সদর উপজেলার পাচঁদোনায় ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের বাড়ী ও গণপাঠাগার, চরমধবপুর মেঘনার তীরে আফজালেরচর, রায়পুরা উপজেলার রামনগরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মৃতি জাদুঘর অন্যতম।